নানা ধরনের বিবরণমূলক রচনার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় আছে। একেক ধরনের রচনায় একেক ধরনের বিবরণ থাকে। কোন ধরনের রচনায় কী ধরনের বিবরণ প্রত্যাশা করা হয়, তার একটি তালিকা করো। প্রথমটি তৈরি করে দেওয়া হলো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯) একজন ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক। তাঁর বিখ্যাত একটি বইয়ের নাম 'ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব'। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে 'সাহিত্য ও সংস্কৃতি', 'তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা', 'ভাষা ও সাহিত্য' ইত্যাদি। নিচের লেখাটি লেখকের 'বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন' গ্রন্থের অংশবিশেষ। এ রচনাটি লেখকের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার বিবরণ।
রচনাটি নীরবে পড়ো এবং এই লেখার মধ্যে লেখকের যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তা খেয়াল করো।
মুহম্মদ আবদুল হাই
প্রায় সাত মাস হলো এখানে এসেছি। সাত মাসে দিন গুনে দিন কুড়ির বেশি সূর্যের আলো দেখেছি বলে মনে হয় না। সকাল বেলায় যদিও সূর্য ওঠে, কিছুক্ষন যেতে না যেতেই বাতাসের বেগ প্রবল হয়, ঠান্ডার প্রকোপ বাড়তে থাকে। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াতে বেড়াতে জমাট বাঁধে। আকাশ আঁধার হয়ে আসে; ধোঁয়ায়, কুয়াশায় আর মেঘের অন্ধকারে সারা লন্ডন দিনের বেলাটায় ধোঁয়াটে অন্ধকার হয়ে যায়। আমি যে পরিষ্কার সূর্যের দেশের লোক, আমার দেশে সকালে সূর্য ওঠে, সারাদিন প্রখর কিরণ ছড়িয়ে সন্ধ্যাবেলায় পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়-পরিষ্কার আলোকিত দিনে মন যে সেখানে প্রফুল্ল থাকে, এই সাত মাস ইংল্যান্ডে বাস করে সে কথা ভুলেই যেতে বসেছি।
এই মেঘ, এই ধোঁয়া, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই কনকনে হাড় ভেদ করা শীত-সবই এ দেশের মানুষের গা- সওয়া হয়ে গেছে। তাই দিনের বেলাকার গোড়ার দিকে হঠাৎ যখন এরা সূর্যের মুখ দেখে, স্নিগ্ধ রোদে চারিদিক যখন ঝলমল করে ওঠে, তখন এদের চোখেমুখে আনন্দের জ্যোতি উপচে পড়ে। পরিচিতে পরিচিতে তো কথাই নেই-অপরিচিতও অপরিচিতকে পথ চলতে গিয়ে মনের আনন্দের ভাগ দেওয়া নেওয়ার জন্য ডেকে বলে- 'কেমন সুন্দর দিনটা, না? হাউ লাভলি'। তার অনুগামী কি সহগামী তার আনন্দ ভাগ করে ভোগ করবার জন্যে ঠিক তেমনি ভাষায় সাড়া দেয়। কিন্তু আলাপ এদেশে বেশি জমে না। ওয়েদার-ই এদের আলাপের পুঁজি। সুতরাং পুঁজি ফুরোলেই চুপ করে যায়।
এরা যেমন চুপ করে থাকতে, আপনার মধ্যে ডুব মেরে থাকতে ভালোবাসে, তেমনি সামান্য কিছু একটা অবলম্বন পেলে প্রাণ খুলে হাসতেও জানে। যে হাসতে জানে, দেখা যায় সে বাঁচতেও জানে। হাসির লহরিতে সব ধুয়ে মুছে যায়। ইংরেজের জাতীয় চরিত্র বড্ড পাক-খাওয়া, কূটবুদ্ধির জন্যে এদের নাম আছে। আর ডিপ্লোমেসির জোরেই এরা এতকাল ধরে দুনিয়াতে প্রভুত্ব করে এলো। কিন্তু এখানে এসে দেখছি ইংরেজ বড়ো কষ্টসহিষ্ণু জাতও। চারিদিকের সাগরের মধ্যে অবস্থিত ইংল্যান্ড একটি দ্বীপবিশেষ। জায়গায় জায়গায় পাহাড়ের মতো উঁচু আর তার পরেই সমতল ভূমির মতো নিচু।
এদের দেশে খাদ্যশস্য বড়ো বেশি ফলে না, যা ফলে তাতে এদের কুলোয় না, তাই বিদেশের দিকে সব কিছুর জন্যেই এদের চেয়ে থাকতে হয়। কিছুদিন থেকে দেখছি গোশত একেবারে উধাও হয়ে গেছে। আর্জেনটিনা, অস্ট্রেলিয়া থেকে এরা মাংস আমদানি করে। আমাদের মতো টাটকা মাংস এরা খেতে পায় না। বিদেশ থেকে তিন চার মাস আগের জবাই করা গোরু, ভেড়া, শুয়োর, খরগোশ জাহাজ বোঝাই করে এদেশে আসে। এরা অতি আদরে সেগুলো দোকানে দোকানে ঝুলিয়ে রাখে। আর মাথাপিছু রেশনে সামান্য একটু যা পায় তাই নিয়ে অতি আনন্দে খায়। দুধ ও দুধজাত জিনিস আসে নিউজিল্যান্ড থেকে। ভিন্ন দেশের জিনিসপত্র না হলে এদের আদৌ চলে না। তাই বলে কি এরা এদের দেশকে কম ভালোবাসে? কত কবি যে এদের আপন দেশের প্রশংসায় মুখর হলেন তা বলে শেষ করা যায় না। এদের দেশ সত্যি ভারি সুন্দর। বৃহত্তম নগরী লন্ডন আর অসংখ্য সাজানো ছোটো গ্রাম আর উঁচুনিচু দিগন্তবিস্তৃত মাঠ নিয়ে সাগরের মাঝখানে গড়ে উঠেছে ইংল্যান্ড দ্বীপ। শেক্সপিয়ার তাঁর দেশকে তাই বলেছেন-রুপালি সমুদ্রের মাঝখানে যেন অমূল্য মণির মতো বসানো রয়েছে এই দেশ ইংল্যান্ড।
এদের প্রকৃতির এই রুদ্র-কঠোরতার কথা যত ভাবি ততই মনে হয় এ জাতটা বড্ড কষ্টসহিষ্ণু আর তেমনি সংগ্রামশীল। রুদ্র প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে এদেরকে বাঁচতে হয়। তাই মনে হয় কাজের চাপে এরা যেমন অকারণ কথা বলে দুদন্ড সময় নষ্ট করার সুযোগ পায় না, আলাপ জমানোটা এরা যেমন ভুলেই গেছে, তেমনি কাজের বোঝা হালকা করে নেবার জন্যে এরা মুখ খুলে হাসতেও শিখেছে। হাসতে পারা যে কত বড়ো কলা তা বোঝা যায় এদের দৈনন্দিন ব্যাবহারের খুঁটিনাটিতে। এদের আমোদ-প্রমোদ, খেলাধুলায়, সিনেমা- থিয়েটারে, প্যান্টোমাইম কি ব্যালেতে যত না দেখি গম্ভীরভাবে জীবনকে গড়ে তোলার তাগিদ, তার বেশি দেখা যায় হাসির মারপ্যাঁচ। ঘরভরা লোক কথায় কথায় হেসে যাচ্ছে। কোনো গোলমাল নেই-হৈ চৈ নেই। বিরাট জনতার প্রাণখোলা হাসির হররায় সমস্তটা ঘর যেন গমগম করছে। দোকানপাটে যাও-বিশেষ করে ছেলেপুলেদের বিভাগে গেলে দেখা যাবে ছেলেমেয়েদের হাসানোর জন্য কত রকমের খেলনার আয়োজন করে রাখা হয়েছে। এমনভাবে এলিস ইন দি ওয়ান্ডার ল্যান্ড, হামটি ডামটি, পিটার পান্ডা, হিফটি টিফটি প্রভৃতির গল্প বা ছড়াকে আকার দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
দোকানে ঢুকলেই মনে হয় যেন আপনা থেকে কাতুকাতু লাগছে। হাসির আবহাওয়াটাই ছোঁয়াচে।
লন্ডনের বিরাটবই মনকে ঘাবড়ে দেয়। পথে বেরোলে মনে হয় যেন নিজকে হারিয়ে ফেলছি। ফুটপাথে অগণিত জনতার ভিড় আর পথ দিয়ে পিঁপড়ের সারির মতো যানবাহন-সেই কোচ, ট্রাক, টিউব-বাস-ট্যাক্সি। তবু ভাগ্য ভালো-যানবাহনের ধাক্কায় জনস্রোত চাপা পড়ে না। তাদের পথ সুনির্দিষ্ট। শৃঙ্খলা প্রশংসাতীতভাবে সুন্দর। একটা পথের কিছু দূর যেতে না যেতেই জনতা যেন ডান বামের পথে কেটে পড়তে পারে তার সুবন্দোবস্ত আছে। মোড় ঘুরবার সময় তো বটেই, ভার আগেই গাড়িগুলো চলতে চলতে পথের মাঝে প্রয়োজনমতো যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় আর স্তব্ধগতি গাড়ির সামনে দিয়ে অপেক্ষমাণ জনতা যেন মোড় ঘুরে যায়, সেজন্য রাস্তার মাঝে মাঝে যেমন স্ট্যান্ড থেকে প্রতি দুমিনিট অন্তর লাল হলুদ ও সবুজ বাতি জ্বলে উঠছে, তেমনি পথের বুকে খাঁজ- কাটা জায়গা দিয়েই যেন তারা এক পথ ডিঙিয়ে আর এক পথে যেতে পারে তার সুন্দর নিদর্শনও আছে।
লাল বাতি জ্বলে উঠলে গাড়িগুলোকে সেখানে অবশ্যই দাঁড়াতে হয়। সবুজ বাতি জ্বললে তারা চলার নির্দেশ পায়। লাল ও সবুজের মধ্যে রং বদলানোর জন্য হলুদ বাতি ক্ষণিকের জন্যে জ্বলে। এদের শৃঙ্খলা যেমন পথে পথে, তেমনি বাড়িঘরে আর সবার ওপরে পথচারী মানুষের মধ্যে। ছককাটা স্কোয়ারের মধ্যে বাড়িঘর আর তার চারপাশ দিয়ে রাস্তা। সবই ছবির মতন। এক রকমের পথ। পথের ধারে এক রকমেরই বাড়ি-দালানের পর দালান একইসঙ্গে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লন্ডন অতি প্রাচীন শহর। পুরানো ইতিহাসের বয়সের চিহ্ন গায়ে মেখে আর ফ্যাক্টরির ধোঁয়ায় লন্ডনের বাড়িঘরগুলোর রং কালো হয়ে গেছে।
শীতের দেশ। এ কারণে এদের বাড়িঘরগুলোতে বারান্দা নেই, ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে খোলা হাওয়া উপভোগ করে আমাদের দেশের মতো ঘুমে ঢলে পড়বার কোনো অয়োজনও নেই। ঘরের কোনো সৌন্দর্য আছে কি না বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই। আয়োজন ও সাজসজ্জা সবই ঘরের ভেতরে। এদের রুচি কতো মার্জিত এবং শীত থেকে বাঁচবার জন্যে এদের দরিদ্রতম মানুষও প্রয়োজনের তাড়নায় কীভাবে যে ঘর সাজায় তা এখানে এসে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। ঘরের ভেতরের দেয়ালগুলো সুন্দর মসৃণ ওয়ালপেপার দিয়ে মোড়া। মেঝেতে অবস্থা ও বুচিভেদে দামি কার্পেট পাতা।
ঘরের জানালাগুলো কাচের। সে কাচও পুরু এবং খুব বড়ো। শীতের ভয়ে জানলা কালেভদ্রে খোলা হয়। খুললেও মানুষ যখন ঘরে না থাকে তখনই জানালা খোলা হয় অক্সিজেন নেবার জন্যে। কাচের জানালার সঙ্গে রুচিমতো পর্দা দেখা যাবে সব বাড়িতেই ঝুলছে।
লন্ডনের বাড়িঘরের সব চাইতে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো তার মাটির নিচেকার ঘর। লন্ডনের প্রতি বিন্দু মাটিকে এখানকার লোকেরা কাজে লাগিয়েছে। সব কিছুতেই মাপজোখ করা পরিকল্পনার ছাপ দেখা যায়।
সমস্ত লন্ডন শহরের মাটির নিচে আছে আর একটি জগৎ। সে জগৎ তার টিউবরেলের জগৎ। সেটা যেমন তার মায়াপুরী তেমনি লন্ডনের অধিকাংশ বাড়ির নিচে আছে দু-এক ভলা ঘর। মাটির নিচে ঘর নেই এমন বাড়ি তো আজও চোখে পড়ল না। এ জন্যেই মাটির সঙ্গে লাগানো তলাটিকে এরা ফার্স্ট ফ্লোর বলে না-বলে গ্রাউন্ড ফ্লোর। আমাদের যেটা দোতলা সেটা এদের ভাষায় ফার্স্ট ফ্লোর। মাটির নিচে বেজমেন্টে কমপক্ষে একটা তলা এদের থাকেই। ল্যান্ডলেডিরা সাধারণত বেজমেন্টে বাস করে। বেজমেন্টের ঘর থেকে যেমন সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ঘরগুলোয় আসা যায়, তেমনি বাড়ির বাইরেও বের হওয়া যায়। বাইরের জগতের সঙ্গে বাড়িওয়ালাদের দৈনিক জীবনের কারবার হয় এ পথে। আমাদের দেশের লোক হঠাৎ এসে যদি বেজমেন্টের ঘরেরই প্রথম সাক্ষাৎ পায় তাহলে তার মনে প্রশ্ন জাগবে মাটির নিচে মানুষ কী করে জীবন কাটায়। এতদিন পরেও আমি মাঝে মাঝে বিস্মিত হই, মুক্ত বাতাস থেকে এরা নিজেদের কীভাবে আড়াল করে রেখেছে। হলোই না হয় শীতের দেশ।
এদের বাড়িঘর রাস্তাঘাট তৈরির মধ্যে যেমন একটা পরিণত পরিকল্পনার ছাপ আছে, তেমনি সময়মতো মুক্ত হাওয়া খেয়ে আসার জন্য ও শহরের মাঝে মাঝে এরা পার্ক তৈরি করে রেখেছে। পার্কগুলো শহরের প্রাসাদ-সমুদ্রের মধ্যে ছোটো ছোটো সবুজ সুন্দর দ্বীপের মতো। বন্ধ ঘর ও কর্মশালা থেকে বেরিয়ে সারাটা ইংরেজ জাত এই পার্কগুলোতে প্রাণ ভরে মুক্তি ও আনন্দের স্বাদ গ্রহণ করে। এজন্যেই শহরের মহল্লার মাঝে মাঝে এমনিভাবে এত পার্ক লন্ডনের বুকের মাঝে সবুজের মোহ ছড়িয়ে নগরবাসীদের হাতছানি দিচ্ছে।
লন্ডন শহরকে নানা অংশে ভাগ করা হয়েছে। এক একটা অংশকে বোরো বলা হয়। আমাদের যেমন মিউনিসিপ্যালিটি, এখানে তেমনি বোরো। প্রত্যেকটি বোরোতেই অনেক পার্ক আছে। পার্কে দেখা যায় নানা রকমের গাছ, ফুলের বাগান, আর সবুজ ঘাস। এ সবের পেছনে প্রচুর খরচ করতে হয়। পার্কের কোনো অংশ যেন কেউ নষ্ট না করে কিংবা ঘাসের ওপর দিয়ে যেন না হাঁটে সে জন্যে আইনের সাবধানবাণী ছাপানো রয়েছে। লন্ডনের সবচেয়ে বড়ো পার্ক হাইডপার্ক, আর সেন্ট জেমস পার্ক। এগুলো এত বড়ো যে, এদের মাঝখানে এসে পৌঁছলে কর্মমুখর কোলাহলরত লন্ডন শহরের আওয়াজও কানে এসে পৌঁছয় না। পার্কগুলোর বাইরে কাজের চাপে সারা লন্ডন গতিভারে ভেঙে পড়েছে অথচ এদের ভেতরে বিরাজ করছে অনাবিল শান্তি। বাঁধনের মাঝে মুক্তি পাবার অনুরূপ আয়োজন বটে।
শীতে সারা লন্ডনের গাছপালা নেড়া হয়ে গিয়েছিল। পাতা নেই অথচ ডালপালা মাথায় করে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে, এ যেমন দেখতে ইচ্ছে করে না, তেমনি অদ্ভুত লাগে। বসন্তকালে এসব নেড়া গাছে পাতা বেরিয়ে সবুজে সবুজে নাকি কোলাকুলি করবে। হয়তো বা হতেও পারে। তার প্রস্তুতি চলছে এখন থেকে। সেই প্রতীক্ষায় আমি চেয়ে থাকলাম।
শব্দের অর্থ
Read more